বিডিনিউজ ১০ ডটকম: সারাদিন তামাকের কাম করি, হাতোত কস (আঠালো পদার্থের প্রলেপ) নাগে। ভালো করি হাত ধুইলেও তা যায় না। ভাতের স্বাদ তিতা নাগে। তয় কী আর করমো, প্যাটে খাইলেতো কাম করায় নাগবে। কয়দিন পরেতা আর তামাক থাইকপার নয়।’
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তার চরে তামাকের পাতা উত্তোলনের পর শুকানোর জন্য বাঁশের কাঠিতে ফোঁড়ানোর সময় এমন কথা বলেন শংকরদহ চরের আকলিমা খাতুন। চরাঞ্চলে তাঁর মতো অনেক পরিবারের সদস্য এখন রবি মৌসুমের এই তামাকের পাতা তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বিকল্প ফসল হিসেবে রংপুরে চলতি বছর ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আলু চাষ হলেও কমেনি ক্ষতিকর তামাকের আবাদ। বিকল্প ফসল উৎপাদনে বীজ প্রাপ্তিতে জটিলতা, উৎপাদন খরচ বেশি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় তামাক চাষের প্রতি চাষিদের দুর্বলতা রয়েই গেছে। তার ওপর তামাক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছে চাষিদের। পরিণতিতে সরকারের নিরুৎসাহিতকরণ সত্ত্বেও তামাক চাষ ছাড়ছেন না উত্তরের চাষিরা।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা। সবুজ ফসলের ক্ষেত ভরা এই উপজেলায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ‘মাদকমুক্ত এলাকা’ লেখা সাইনবোর্ড। কিন্তু বাস্তবে এখানকার চিত্র উল্টো। সুজলা সুফলা মাঠে ছেয়ে গেছে মাদকের সিঁড়ি তামাকে। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন কম্পানি চাষিদের বিনা পুঁজিতে তামাক চাষে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছেন। বেশি লাভের বাড়তি আশার সঙ্গে বাজারজাতের নিশ্চয়তায় তামাক চাষ করছেন চাষিরা। এতে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে ফসলের ক্ষেত। জেনে শুনে বিষ চাষের এই চিত্র কেবল তারাগঞ্জে নয়।
রংপুর জেলার পাশাপাশি লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীতেও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে তামাকের চাষ। খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য খ্যাত রংপুর অঞ্চলে প্রতিবছরই ধান, আলুসহ কৃষি ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার হতাশা কৃষকের চোখে পানি আনে। এই আহাজারির সুযোগকে লুফে নিয়ে বিনামূল্যে বিষাক্ত তামাকের বীজ কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা তামাক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কম্পানির প্রতিনিধিরা।
সচেতন মহলের দাবি, তামাক চাষ বন্ধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে না পারলে আগামী দিনে উত্তরের এই জনপদে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে।
সরজমিনে দেখা যায়, রংপুর অঞ্চলে রবি মৌসুমের ফসল হিসেবে ব্যাপক এলাকায় আলু চাষ হলেও তামাক চাষে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। যেদিকে চোখ যায়, তামাক আর তামাক। বিশেষ করে তিস্তার বালুচর যেন তামাকের নিচে ঢাকা পড়েছে। চাষিদের ব্যস্ত সময় কাটছে। তামাকের ক্ষেতে সেচ প্রদান, পাতা সংগ্রহ ও শুকানোর কাজ করছেন তাঁরা।
গঙ্গাচড়ার তিস্তার চর ছাড়াও রংপুর সদরের পাগলাপীর, মমিনপুর, তারাগঞ্জের শলেয়াসা, মিঠাপুকুরের বড় হযরতপুর, পীরগাছার তাম্বুলপুর, কাউনিয়ার সানাইসহ বিভিন্ন এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত যেন সবুজে ছেয়ে গেছে। কিন্তু আসলে তা ফসল নয়, একটু কাছাকাছি গেলেই চোখে পড়ে মাঠে মাঠে বাড়ন্ত তামাকের চারা। সবুজের আড়ালে প্রতিটি পাতার শিরা, উপশিরায় বিষাক্ত নিকোটিন নিয়ে বেড়ে উঠছে একেকটি তামাকের গাছ।
রংপুর সদরের পালিচড়া এলাকার আহাম্মদ আলী ও ওসমান গণি বলেন, ‘সারা বছর তো শস্যের আবাদ করি। কিন্তু দামের বেলায় পুঁজি বাঁচানোর চিন্তায় কান্নাকাটি করা নাগে। তামাক চাষের মধ্যে ওই টেনশন নাই। কম্পানি থাকি বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়, দু’পয়সা বেশি রোজগারও হয়।’
পীরগাছার তাম্বুলপুর এলাকার নূর আমিন বলেন, ‘তামাক আবাদে ক্ষতি হয় জানি। কিন্তু গরিবের আয় রোজগারের জন্য সুবিধা আছে। কম্পানি থেকে লোন সুবিধার পাশাপাশি বীজ ও সার পাওয়া যায়। আবার বাজারজাত নিয়েও চিন্তা থাকে না। তিনি বলেন, তামাকের আঠা খুব তিতা। একদিন তামাকের কাজ করলে অন্তত দুই দিন ঠিকমতো ভাত খাওয়া যায়না, তিতা লাগে। তবে তামাক চাষে লাভ হওয়ায় তা মেনে নিতে বাধ্য হওয়া লাগে।
তামাক ক্ষেতে কর্মরত একই এলাকার আলী হোসেন বলেন, ‘বিকল্প ফসল হিসেবে আলু আবাদে অনেক টাকা লাগে। তাছাড়া তামাক চাষ করলে ঋণও পাওয়া যায়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, এক সময় তামাকই ছিল রংপুর অঞ্চলের প্রধান ফসল। তামাক সংশ্লিষ্ট দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে এখানকার ভার্জিনিয়া জাতের তামাকের কদর ছিল প্রচুর। তামাককে ঘিরে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা দেশব্যাপী বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিনা পুঁজিতে তামাকের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। সে সময় বিড়ি, সিগারেট, গুল, জর্দাসহ তামাক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এ অঞ্চলে।
এলাকার চাষিদের প্রয়োজনকে সামনে রেখেই তদানিন্তন বৃটিশ সরকারের সার্ভে অনুযায়ী ১৯০৮ সালে রংপুরের বুড়িরহাটে স্থাপিত হয় তামাক গবেষণা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি সে সময়ে দেশের ভেতর এবং বিদেশ থেকে ১১৪টি তামাকের জাত সংগ্রহ করে। এছাড়া সুরভি ও সুগন্ধি নামক উচ্চ ফলনশীল দুটি জাতসহ নতুন নতুন তামাকের জাত উদ্ভাবন করে প্রতিষ্ঠানটি।
পরবর্তীতে তামাকের ক্ষতিকারক দিক বিবেচনা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এর চাষে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে চাষিদের। এর অংশ হিসেবে একসময় তামাক ক্রয়কারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টোব্যাকো কম্পানির (বিটিসি) রংপুর ডিপো বন্ধ হয়ে যায়। তামাক গবেষণা কেন্দ্রটি রূপ পাল্টে পরিণত হয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিকল্প হিসেবে ভুট্টা, সূর্যমূখী, সরিষা, বাদাম, শাকসব্জি চাষ করে চাষিরা যাতে তামাকের চেয়ে বেশি লাভ পেতে পারে সে বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তারপরও ক্ষতিকর তামাকের চাষ বন্ধ হয়নি।
তামাক থেকে মুখ ফেরাতে চাষিদের সচেতন করা হচ্ছে বলে জানান রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, তামাক জীবনঘাতী নিকোটিন সমৃদ্ধ। মরণব্যাধি ক্যানসারের অন্যতম উপাদান এই বিষপাতা। ক্ষতির সবদিক জানার পরও বাজারজাতের নিশ্চয়তা থাকায় চাষিদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। এই অঞ্চলে এবার প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লালমনিরহাটে। এভাবে তামাক চাষ চলতে থাকলে এই অঞ্চলের ফসল উৎপাদন কমে আসবে বলেও জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
এদিকে, এই বিষবৃক্ষের উৎপাদন ঠেকাতে হলে চাষিদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিসহ আইনের প্রয়োগ জরুরি বলে মনে করছেন তামাক নিয়ন্ত্রণ কোয়ালিশনের ফোকাল পারসন সুশান্ত ভৌমিক। তিনি বলেন, আইন আছে-সেটার প্রকৃত ব্যবহার করতে পারলে তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তবে এর আগে চাষিদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি তামাকজাতকরণ কম্পানিগুলোর দৌরাত্ম থামাতে হবে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ধান, আলুসহ কৃষি ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে কৃষকদের বাঁচাতে হবে। কৃষকরা বাঁচলে তামাক চাষ কমে আসবে। তামাক চাষ পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এই কৃষক নেতা